বন্ধুরা, কেমন আছেন সবাই? আপনাদের প্রিয় বন্ধু আমি, আবার এক নতুন গল্প নিয়ে হাজির হয়েছি, যা হয়তো আপনাদের অনেকেরই খুব চেনা এক অনুভূতির কথা বলবে। আমরা যখন কোনো নতুন স্বপ্ন দেখি, বিশেষ করে এমন কিছু যা আমাদের আবেগের সাথে জড়িয়ে থাকে, তখন শুরুটা যতটা উজ্জ্বল মনে হয়, পথটা কিন্তু সবসময় মসৃণ হয় না, তাই না?
জাপানিজ রান্নার জগতে আমার প্রথম পা রাখাটা তেমনই এক অভিজ্ঞতার সমষ্টি ছিল। আজ অনেকেই হয়তো আমার সুশি বা রামেন তৈরির প্রশংসা করেন, কিন্তু শুরুর দিকের গল্পটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।আসলে, সুশি তৈরি থেকে শুরু করে, এমনকি সাধারণ রান্নার প্রাথমিক কৌশলগুলোতেও আমি বারবার হোঁচট খেয়েছি। মনে আছে, একবার রাইস কুক করার সময় এতটাই ভুল করেছিলাম যে পুরো ব্যাচটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আর তখন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। সেই সময় মনে হতো, এত কঠিন একটা পেশায় টিকে থাকা কি আদৌ সম্ভব?
বিশেষ করে যখন চারপাশে এত বেশি প্রতিযোগিতা আর নিখুঁততার চাপ। অনেকেই হয়তো বাইরে থেকে আমার যাত্রাটা দেখে সহজ মনে করতেন, কিন্তু ভেতরের সংগ্রামটা ছিল অন্যরকম।সেই ব্যর্থতাগুলো আমাকে শুধু হতাশই করেনি, বরং শেখার এক দারুণ সুযোগও করে দিয়েছে। এখন বুঝি, প্রতিটি ভুলই ছিল এক একটি ধাপ, যা আমাকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। আসুন, আমার সেই শুরুর দিনের সংগ্রাম আর সেখান থেকে শেখা দারুণ সব পাঠ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
মৌলিক কৌশল আয়ত্ত করার চ্যালেঞ্জ

জাপানিজ রান্নার জগতে আমার প্রথম পা রাখার পর, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এর মৌলিক কৌশলগুলো আয়ত্ত করা। অনেকেই হয়তো মনে করেন, রান্না মানেই কেবল উপকরণগুলো মিশিয়ে কিছু একটা তৈরি করা। কিন্তু জাপানিজ কুইজিনে, প্রতিটি ছোট ছোট ধাপের পেছনে রয়েছে গভীর দর্শন এবং নিখুঁততার এক অসাধারণ দাবি। আমার মনে আছে, সুশি চাল তৈরি করাটা আমার জন্য এক বিশাল পাহাড়ের মতো ছিল। চাল ধোয়া থেকে শুরু করে সঠিক পরিমাণে জল দিয়ে সেদ্ধ করা, তারপর ভিনেগার মিশ্রণটি ঠিকমতো মিশিয়ে প্রতিটি চালের দানাকে আলাদা এবং আঠালো রাখা – এই পুরো প্রক্রিয়াটা ছিল এক অগ্নিপরীক্ষার মতো। একবার মনে আছে, চাল এতটাই বেশি সেদ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে তা কেবল একটি পিণ্ডে পরিণত হয়েছিল, আর তখন আমার নিজেকে একজন ব্যর্থ রন্ধনশিল্পী ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছিল না। আমার প্রশিক্ষক সে সময় হাসলেও, আমি বুঝতে পারছিলাম, এই কাজটা শেখা কতটা কঠিন। প্রতিটি ব্যর্থতা আমাকে আরও বেশি শেখার দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রথম প্রথম এই চাপ সামলাতে বেশ কষ্ট হতো, কিন্তু এখন আমি বুঝি, এই কঠিন পথটাই আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হয়। জাপানিজ রান্না কেবল হাত দিয়ে করা হয় না, হৃদয় দিয়েও করা হয়।
উপকরণ পরিচিতি ও ব্যবহার
জাপানিজ রান্নার ক্ষেত্রে প্রতিটি উপকরণের সঠিক ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমার শুরুর দিকে এই বিষয়টি বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। কোন মাছ কিভাবে কাটতে হবে, কোন সস কখন ব্যবহার করতে হবে, এমনকি একটি সবজির কোন অংশ রান্নার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত – এই বিষয়গুলো আমার কাছে ছিল এক বিরাট রহস্য। একবার মনে আছে, আমি ভুল করে ওয়াসাবি বেশি ব্যবহার করে ফেলেছিলাম, যা পুরো খাবারটির স্বাদ নষ্ট করে দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে খুব খারাপ ছিল, কারণ আমি জানতাম না যে ওয়াসাবি এত শক্তিশালী হতে পারে। এখন আমি প্রতিটি উপকরণের সাথে পরিচিত, তাদের বৈশিষ্ট্য এবং কিভাবে তারা খাবারের স্বাদকে প্রভাবিত করে তা আমি বুঝি। প্রতিটি নতুন উপকরণ নিয়ে কাজ করার সময় আমি গভীর মনোযোগ দেই, কারণ একটি ছোট ভুলও পুরো রান্নার পরিশ্রম নষ্ট করে দিতে পারে। এই জ্ঞান আমাকে রান্নার জগতে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।
কাটার কৌশল ও নির্ভুলতা
রান্নার জগতে, বিশেষ করে জাপানিজ কুইজিনে, কাটার কৌশল একটি শিল্প। ছুরির সঠিক ব্যবহার, সবজি বা মাছ কাটার ধরণ, সবকিছুই খাবারের স্বাদ এবং উপস্থাপনাকে প্রভাবিত করে। আমি যখন প্রথম সুশি মাছ কাটা শুরু করি, আমার হাত কাঁপত, আর ফলস্বরূপ মাছগুলো অসমানভাবে কাটা হতো। একবার একজন সিনিয়র শেফ আমার কাটা মাছ দেখে বলেছিলেন, “এই মাছ দিয়ে সুশি তৈরি করলে কেউ খেতে চাইবে না।” কথাটি আমার কাছে খুব কষ্টদায়ক ছিল, কিন্তু তিনি ঠিকই বলেছিলেন। সেই দিন থেকে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে কাটার অনুশীলন করেছি। এখন, আমার ছুরি যেন আমার হাতেরই একটি অংশ। আমি জানি কিভাবে মসৃণভাবে মাছ কাটতে হয়, কিভাবে প্রতিটি সবজির সঠিক আকার দিতে হয়, যাতে তারা দেখতে সুন্দর লাগে এবং মুখেও দারুণ অনুভব হয়। এই নির্ভুলতা কেবল অনুশীলনের মাধ্যমেই আসে, আর আমি মনে করি, একজন ভালো শেফ হতে হলে এই দক্ষতা অর্জন করা অপরিহার্য।
ধৈর্য এবং অধ্যবসায়: সাফল্যের চাবিকাঠি
আমার যাত্রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি হলো ধৈর্য এবং অধ্যবসায়। জাপানিজ রান্না শুধু একটি কৌশলগত কাজ নয়, এটি একটি জীবনদর্শনও বটে। এখানে তাড়াহুড়ো করার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি পদ তৈরি করতে যে সময় এবং পরিশ্রম লাগে, তা ধৈর্য ছাড়া সম্ভব নয়। আমার মনে পড়ে, যখন আমি প্রথম রামেন ব্রথ তৈরি করা শিখছিলাম, তখন ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে হাড় সেদ্ধ করতে হতো, যার জন্য প্রচণ্ড ধৈর্যের প্রয়োজন ছিল। ব্রথের স্বাদ এবং ঘনত্ব সঠিক করতে দিনের পর দিন ধরে একই প্রক্রিয়া পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছে। অনেক সময় মনে হতো, এত সময় ব্যয় করে একটি মাত্র পদ তৈরি করা কি আদৌ মূল্যবান?
কিন্তু যখন আমি একটি নিখুঁত ব্রথের স্বাদ গ্রহণ করতাম, তখন মনে হতো আমার সব পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে বড় কিছু অর্জন করতে হলে, ছোট ছোট ব্যর্থতাগুলোকে মেনে নিয়েও সামনে এগিয়ে যেতে হয়। কোনো কিছু সহজে আসে না, সফলতার জন্য কঠোর পরিশ্রম এবং অটল সংকল্প অপরিহার্য। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে।
বিরূপ পরিস্থিতিতে শেখা
রান্নাঘরে কাজ করার সময় আমি বিভিন্ন বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। কখনো কাজের অতিরিক্ত চাপ, কখনো ভুল বোঝাবুঝি, আবার কখনো নতুন কিছু শেখার সময় হতাশা। একবার একটি বড় অর্ডারের সময় সব কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল, আমি আর এই কাজটা চালিয়ে যেতে পারব না। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার সিনিয়র শেফ আমাকে শিখিয়েছিলেন কিভাবে শান্ত থাকতে হয় এবং সমস্যা সমাধান করতে হয়। তিনি বলেছিলেন, “রান্নাঘর হলো যুদ্ধক্ষেত্রের মতো, এখানে প্রতিটি সমস্যাকে ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করতে হয়।” তার সেই কথাগুলো আমার জীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলেছে। এখন আমি জানি, যেকোনো পরিস্থিতিতেই আমাকে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে। এই প্রতিকূলতাগুলো আমাকে মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে।
লক্ষ্যে অবিচল থাকা
একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল থাকাটা আমার সাফল্যের অন্যতম কারণ। যখন আমি জাপানিজ রান্নার জগতে প্রবেশ করি, আমি নিজেকে একজন সেরা শেফ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছিলাম। যদিও পথটা সহজ ছিল না, অসংখ্য বাধা বিপত্তি ছিল, তবুও আমি আমার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হইনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে অনুশীলন করা, নতুন নতুন রেসিপি নিয়ে গবেষণা করা, সহকর্মীদের কাছ থেকে শেখা – এই সবকিছুই আমাকে আমার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমি বিশ্বাস করি, যদি আপনার একটি স্পষ্ট লক্ষ্য থাকে এবং আপনি সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে ইচ্ছুক হন, তবে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। আমার এই যাত্রা প্রমাণ করে যে স্বপ্ন দেখতে শেখা এবং সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা করা কতটা জরুরি।
উপকরণ চেনা ও তাদের সঠিক ব্যবহার
জাপানিজ রান্নায় উপকরণের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি উপাদানের নিজস্ব একটি গল্প আছে, একটি নির্দিষ্ট চরিত্র আছে। সঠিক উপকরণ নির্বাচন এবং তার যথাযথ ব্যবহারই একটি রান্নার চূড়ান্ত স্বাদ ও মান নির্ধারণ করে। আমি যখন প্রথম সুশির জন্য মাছ নির্বাচন করতে শিখি, তখন আমাকে মাছের সতেজতা, তার গঠন এবং গন্ধ সম্পর্কে শিখতে হয়েছে। একটি ভালো সুশি কেবল ভালো চাল দিয়েই হয় না, সেরা মানের মাছ দিয়েও হয়। আমার মনে আছে, একবার বাজারে গিয়ে আমি ভুল করে এমন মাছ কিনে এনেছিলাম যা সুশির জন্য উপযুক্ত ছিল না। সেই মাছ ব্যবহার করে তৈরি সুশিগুলো মোটেই ভালো হয়নি। তখন আমি বুঝতে পারি, কেবলমাত্র রেসিপি জানা যথেষ্ট নয়, উপকরণ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকাও অপরিহার্য। একজন শেফ হিসেবে, আমি মনে করি, প্রতিটি উপকরণের সাথে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করা উচিত, তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো গভীরভাবে বোঝা উচিত।
ঋতুভিত্তিক উপকরণের মাহাত্ম্য
জাপানিজ রান্নায় ঋতুভিত্তিক উপকরণের ব্যবহার একটি ঐতিহ্য। প্রতিটি ঋতুতে প্রকৃতির কাছ থেকে যে তাজা উপকরণ পাওয়া যায়, তার স্বাদ এবং গুণগত মানই অনন্য। আমি যখন জাপানে ছিলাম, তখন শিখেছিলাম কিভাবে ঋতু অনুযায়ী উপকরণ ব্যবহার করতে হয়। গ্রীষ্মকালে হালকা মাছ ও সবজি, শীতকালে ভারী ও পুষ্টিকর খাবার – এই নিয়মগুলো আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে রান্না করতে হয়। ঋতুভিত্তিক রান্না কেবল স্বাস্থ্যকরই নয়, এটি খাবারের স্বাদকেও বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। আমি এখন সর্বদা চেষ্টা করি ঋতুভিত্তিক উপকরণ ব্যবহার করতে, কারণ আমি বিশ্বাস করি, এতে খাবারের আসল স্বাদ বজায় থাকে। এটি আমার রান্নার দর্শনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
স্বাদ ও টেক্সচারের ভারসাম্য
জাপানিজ রান্নার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্বাদ এবং টেক্সচারের ভারসাম্য। একটি পদে মিষ্টি, টক, নোনতা এবং উমামি (umami) স্বাদের সঠিক সমন্বয় থাকতে হবে। একই সাথে, বিভিন্ন উপকরণের টেক্সচার যেন একে অপরের পরিপূরক হয়, সেটাও দেখতে হয়। একবার আমি এমন একটি রামেন তৈরি করেছিলাম যেখানে ব্রথটি অতিরিক্ত ঘন হয়ে গিয়েছিল এবং নুডলসগুলো নরম ছিল না। তখন বুঝতে পেরেছিলাম, স্বাদের সাথে টেক্সচারের ভারসাম্য রাখা কতটা জরুরি। এখন আমি প্রতিটি পদ তৈরি করার সময় এই ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করি। এটি শুধুমাত্র একটি রান্নার কৌশল নয়, এটি এক ধরনের শৈল্পিক প্রকাশ, যেখানে প্রতিটি উপাদান একে অপরের সাথে মিলে একটি সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
জাপানিজ রান্নার দর্শনে নিজেকে খুঁজে পাওয়া
আমার জাপানিজ রান্নার জগতে প্রবেশ কেবল একটি পেশা হিসেবে শুরু হলেও, ধীরে ধীরে এটি আমার জীবনদর্শন হয়ে উঠেছে। জাপানিজ রন্ধনশিল্প কেবল খাবার তৈরি করা নয়, এটি মনোযোগ, শ্রদ্ধা এবং সৌন্দর্যের এক অপরূপ মিশ্রণ। এখানে প্রতিটি কাজে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে, একটি গভীর অর্থ থাকে। আমি যখন প্রথম জাপানে রান্না শেখার সুযোগ পাই, তখন আমি শুধু রেসিপি শিখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি যা শিখেছি, তা শুধু রেসিপি নয়, তা হলো একটি সংস্কৃতি, একটি জীবন পদ্ধতি। প্রতিটি উপাদানকে শ্রদ্ধা জানানো, প্রতিটি ধাপকে গুরুত্ব সহকারে দেখা, এবং প্রতিটি খাবারকে শিল্প হিসেবে উপস্থাপন করা – এই দর্শনগুলো আমার জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। এই যাত্রায় আমি শুধু একজন শেফই হয়ে উঠিনি, বরং নিজেকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছি।
ওয়াবি-সাবি এবং ইচি-গো ইচি-ই
জাপানিজ সংস্কৃতিতে ওয়াবি-সাবি (wabi-sabi) এবং ইচি-গো ইচি-ই (ichi-go ichi-e) এই দুটি ধারণা আমার রান্নার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ওয়াবি-সাবি আমাকে শিখিয়েছে অসম্পূর্ণতার সৌন্দর্যকে কিভাবে উপভোগ করতে হয়। নিখুঁত হওয়ার পেছনে দৌড়ানোর পরিবর্তে, আমি এখন প্রতিটি খাবারের অসম্পূর্ণতা বা প্রাকৃতিক রূপকে শ্রদ্ধা জানাই। ইচি-গো ইচি-ই, যার অর্থ হলো “একবার, এক সাক্ষাৎ”, আমাকে প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্য দিতে শিখিয়েছে। রান্নার প্রতিটি ধাপ, প্রতিটি কাট, প্রতিটি মিশ্রণ – সবই অনন্য এবং এর পুনরাবৃত্তি হবে না। তাই প্রতিটি মুহূর্তকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করা উচিত। এই দর্শনগুলো আমার রান্নায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যেখানে কেবল খাবার তৈরি হয় না, বরং একটি আবেগ এবং একটি অভিজ্ঞতা তৈরি হয়।
মিন্দফুলনেস এবং মনোযোগ
জাপানিজ রান্না আমাকে শিখিয়েছে মিন্দফুলনেস বা সচেতনতা। প্রতিটি কাজ করার সময় পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে করা। যখন আমি মাছ কাটি, তখন আমার সমস্ত মনোযোগ থাকে ছুরির উপর, মাছের গঠনের উপর। যখন আমি চাল সেদ্ধ করি, তখন আমি প্রতিটি চালের দানা অনুভব করি, জল ফুটন্ত শব্দ শুনি। এই ধরনের মনোযোগ আমাকে শুধু ভালো রান্না করতেই সাহায্য করে না, এটি আমার মনকে শান্ত রাখে এবং আমাকে বর্তমান মুহূর্তে বাঁচতে শেখায়। এই মিন্দফুলনেস আমার প্রতিদিনের জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। এটি আমাকে স্ট্রেস মোকাবিলা করতে এবং আরও বেশি উৎপাদনশীল হতে সাহায্য করে। আমি মনে করি, এই দর্শনটি কেবল রান্নাঘরে নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ব্যর্থতাকে আলিঙ্গন করা: মানসিকতার পরিবর্তন

আমার শুরুর দিনগুলোতে ব্যর্থতা ছিল আমার নিত্যসঙ্গী। প্রতিটি ভুল আমাকে হতাশ করত, আমার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিত। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম, ব্যর্থতা কেবল একটি শেখার সুযোগ, একটি ধাপ যা আমাকে আরও ভালো কিছুর দিকে নিয়ে যাবে। আমি যখন প্রথম সুশি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম, তখন মনে হয়েছিল এই কাজটা আমার জন্য নয়। কিন্তু আমি সেই ব্যর্থতাকে গ্রহণ করে আবার চেষ্টা করেছি, নতুনভাবে শিখেছি। আমার মনে আছে, একবার আমি এতটাই হতাশ হয়েছিলাম যে প্রায় রান্নার জগত ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু আমার এক সিনিয়র শেফ বলেছিলেন, “যে মানুষ ভুল করে না, সে নতুন কিছু শেখেও না।” তার সেই কথাগুলো আমাকে নতুন করে শক্তি জুগিয়েছিল। এখন আমি বিশ্বাস করি, ব্যর্থতাই সাফল্যের পথ প্রশস্ত করে। এটি আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হয় এবং প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখতে হয়।
ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ
ভুল করাটা স্বাভাবিক, কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করাটাই আসল বিষয়। আমার রান্নাঘরে যতবার আমি ভুল করেছি, ততবারই আমি নতুন কিছু শিখেছি। একবার ডিম রোল (তামাগোয়াকি) তৈরি করার সময় আমি বারবার ডিমগুলো ভেঙে ফেলছিলাম। তখন আমি প্রতিটি ধাপ বিশ্লেষণ করে দেখেছিলাম কোথায় ভুল হচ্ছে। আমি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি এবং ডিমগুলো অতিরিক্ত সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এই ভুল থেকে শিখে আমি পরবর্তীকালে নিখুঁত তামাগোয়াকি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। প্রতিটি ভুল আমাকে আমার দুর্বলতাগুলো চিনতে এবং সেগুলোকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে। এই প্রক্রিয়াটি আমাকে একজন দক্ষ রন্ধনশিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছে।
পুনরায় চেষ্টা করার সাহস
ব্যর্থতার পর পুনরায় চেষ্টা করার সাহস থাকাটা খুব জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, একবার ব্যর্থ হলে মানুষ আর চেষ্টা করতে চায় না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, পুনরায় চেষ্টা করার মাধ্যমেই আসল সাফল্য আসে। আমি যখন প্রথম রামেন ব্রথ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম, তখন মনে হয়েছিল এর চেয়ে কঠিন কিছু নেই। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। বারবার চেষ্টা করে, বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে আমি শেষ পর্যন্ত একটি দারুণ রামেন ব্রথ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এই সাহস আমাকে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আমার এই যাত্রাটি আমাকে শিখিয়েছে যে সফল হতে হলে কখনো হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না, বরং দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
প্রতিক্রিয়া গ্রহণ এবং নিজেকে উন্নত করা
একজন শেফ হিসেবে, প্রতিক্রিয়া (feedback) গ্রহণ করা এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে উন্নত করাটা অপরিহার্য। আমার শুরুর দিনগুলোতে, যখন আমার রান্নার সমালোচনা করা হতো, তখন আমি কিছুটা কষ্ট পেতাম। কিন্তু আমি দ্রুতই বুঝতে পেরেছিলাম যে এই প্রতিক্রিয়াগুলো আমার উন্নতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার প্রশিক্ষকরা, আমার সিনিয়র শেফরা এবং এমনকি গ্রাহকরাও আমাকে মূল্যবান প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, যা আমাকে আমার ভুলগুলো চিনতে এবং সেগুলোকে সংশোধন করতে সাহায্য করেছে। একবার একজন গ্রাহক আমার তৈরি একটি পদ সম্পর্কে বলেছিলেন যে এতে লবণের পরিমাণ বেশি হয়ে গিয়েছিল। সেই দিন থেকে আমি খাবারের স্বাদ নেওয়ার সময় লবণের বিষয়ে আরও সতর্ক হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, একজন ভালো শেফ হতে হলে অন্যের কথা শুনতে জানতে হয় এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে পরিবর্তন করতে হয়।
| রান্নার উপাদান/কৌশল | শুরুর দিকের অভিজ্ঞতা | বর্তমান দক্ষতা |
|---|---|---|
| সুশি চাল তৈরি | বারবার সঠিক আঠালোতা না পাওয়া, অতিরিক্ত বা কম সেদ্ধ হওয়া। | অনায়াসে নিখুঁত দানাদার ও আঠালো চাল তৈরি, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ। |
| ডিম রোল (তামাগোয়াকি) | ভেঙে যাওয়া, অসমান স্তর, পুড়ে যাওয়া। | মসৃণ, সোনালী ও বহু-স্তরবিশিষ্ট তামাগোয়াকি তৈরি। |
| রামেন ব্রথ | স্বাদ ও ঘনত্বের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে না পারা, অতিরিক্ত লবণাক্ত বা পানসে। | গভীর ও জটিল স্বাদের ব্রথ তৈরি, উপকরণের সঠিক অনুপাত। |
শেখার প্রক্রিয়াকে মূল্য দেওয়া
শেখার প্রক্রিয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা কখনো শেষ হয় না। আমি যখন প্রথম রান্না শুরু করি, তখন ভেবেছিলাম কিছু রেসিপি শিখলেই সব হয়ে যাবে। কিন্তু আমি দ্রুতই বুঝতে পেরেছিলাম যে রান্নার জগতে প্রতিদিন নতুন কিছু শেখার আছে। নতুন কৌশল, নতুন উপকরণ, নতুন ফ্লেভার কম্বিনেশন – এই সবকিছুই শেখার অংশ। আমি আমার সিনিয়র শেফদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি, যারা তাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান আমার সাথে শেয়ার করেছেন। আমি নিয়মিত রান্নার বই পড়ি, নতুন রেসিপি নিয়ে গবেষণা করি এবং বিভিন্ন রন্ধনশিল্পীদের কাজ দেখি। এই শেখার প্রক্রিয়াটি আমাকে একজন দক্ষ এবং আধুনিক শেফ হিসেবে তৈরি করেছে। আমি মনে করি, যে মানুষ শেখার প্রক্রিয়াকে মূল্য দেয়, সে জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে।
স্ব-পর্যালোচনা এবং উন্নতি
প্রতিক্রিয়া গ্রহণের পাশাপাশি স্ব-পর্যালোচনাও একজন শেফের জন্য অত্যন্ত জরুরি। আমি প্রতিটি রান্নার পর নিজেই নিজের কাজ পর্যালোচনা করি। কোথায় আরও ভালো করা যেত, কোথায় ভুল হয়েছে – এই বিষয়গুলো আমি নিজেই বিশ্লেষণ করি। এই স্ব-পর্যালোচনা আমাকে আমার দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করতে এবং সেগুলোকে সংশোধন করতে সাহায্য করে। আমার মনে আছে, একবার একটি পার্টিতে আমি আমার তৈরি একটি সুশি পরিবেশন করেছিলাম। পরে যখন আমি নিজেই সেটি খেয়েছিলাম, তখন আমার মনে হয়েছিল যে এতে আরও কিছু উন্নতি করা দরকার। এই আত্ম-পর্যালোচনা আমাকে আমার কাজ সম্পর্কে আরও সচেতন করে তোলে এবং আমাকে নিজেকে আরও উন্নত করার অনুপ্রেরণা দেয়। এটি আমার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত বিকাশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
একটি শেফের যাত্রা: শুধু রান্না নয়, শিল্পকলা
আমার কাছে একজন শেফের যাত্রা কেবল খাবার তৈরি করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি শিল্পকলা, একটি আবেগ এবং একটি জীবনযাপন পদ্ধতি। আমি যখন প্রথম রান্না শুরু করি, তখন আমি শুধু একটি চাকরি হিসেবে দেখেছিলাম। কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে, আমি ততই বুঝতে পেরেছি যে এটি আমার জীবনের একটি গভীর অংশ। প্রতিটি পদ তৈরি করার সময় আমি আমার আবেগ, আমার ভালোবাসা এবং আমার দক্ষতা প্রয়োগ করি। আমি বিশ্বাস করি, রান্না এমন একটি শিল্প যা মানুষকে একত্রিত করে, মানুষকে আনন্দ দেয়। একটি প্লেটে সাজানো খাবার শুধু পেট ভরানোর জন্য নয়, এটি চোখ এবং মনের জন্যও একটি ভোজ। আমার এই যাত্রাটি আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে প্রতিটি কাজকে শিল্পের চোখে দেখতে হয় এবং কিভাবে প্রতিটি পদকে একটি গল্পে পরিণত করতে হয়।
সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ
রান্না আমার কাছে সৃষ্টিশীলতার একটি অসাধারণ মাধ্যম। নতুন রেসিপি তৈরি করা, পুরনো রেসিপিগুলোকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা, বিভিন্ন উপকরণের সাথে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা – এই সবকিছুই আমার সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করার সুযোগ করে দেয়। আমার মনে আছে, একবার আমি একটি ঐতিহ্যবাহী জাপানিজ পদকে নতুন ফ্লেভার এবং টেক্সচার দিয়ে তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলাম। আমার গ্রাহকরা সেই পদটি এতটাই পছন্দ করেছিলেন যে তারা বারবার সেটি অর্ডার করতে শুরু করেছিলেন। এই ধরনের অভিজ্ঞতা আমাকে আরও বেশি সৃষ্টিশীল হতে উৎসাহিত করে। আমি বিশ্বাস করি, একজন শেফ কেবল রেসিপি ফলো করে না, সে একজন শিল্পী যে তার নিজের হাতে নতুন কিছু তৈরি করে।
সংযোগ এবং আবেগ
রান্না মানুষকে একত্রিত করে, এটি একটি অসাধারণ সংযোগের মাধ্যম। আমার তৈরি খাবার যখন মানুষকে আনন্দ দেয়, তাদের মুখে হাসি ফোটে, তখন আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। একবার আমার এক গ্রাহক বলেছিলেন যে আমার তৈরি রামেন খেয়ে তার মনে হয়েছে যেন তার মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছেন। সেই কথাটি আমার কাছে এতটাই আবেগপ্রবণ ছিল যে আমি নিজেই চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। এই ধরনের সংযোগ এবং আবেগই আমাকে প্রতিদিন আরও ভালো রান্না করতে অনুপ্রাণিত করে। আমি বিশ্বাস করি, একজন শেফ হিসেবে আমার কাজ কেবল খাবার তৈরি করা নয়, মানুষকে সুখ এবং তৃপ্তি দেওয়া। এটি আমার পেশার সবচেয়ে সুন্দর দিক।
글을মাচিয়ে
প্রিয় বন্ধুরা, আমার এই জাপানিস রান্নার পথচলার গল্প হয়তো আপনাদের অনেকেরই নিজেদের স্বপ্ন পূরণের যাত্রার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আসলে, জীবনের প্রতিটি ধাপে আমরা যখন কোনো নতুন কিছু শিখতে চাই, তখন হোঁচট খাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই হোঁচট খেয়ে পড়ে না গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানো, আর সেই ভুলগুলো থেকে শিখে সামনে এগিয়ে যাওয়াই আসল চ্যালেঞ্জ, তাই না? আমার এই অভিজ্ঞতা যদি আপনাদের মনে সামান্য হলেও অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে, তবে আমার এই গল্প বলা সার্থক। মনে রাখবেন, কোনো স্বপ্নই অধরা থাকে না, শুধু প্রয়োজন দৃঢ় সংকল্প আর অদম্য চেষ্টা।
আলরাদুমান সুলমো ইন্নো থোবো
আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কার্যকরী টিপস আপনাদের জন্য তুলে ধরছি, যা কেবল রান্নায় নয়, জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই কাজে লাগতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
১. ব্যর্থতাকে ভয় পাবেন না, বরং এটিকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখুন। প্রতিটি ভুলই আপনাকে আপনার লক্ষ্যের আরও কাছে নিয়ে যাবে। আমি যখন প্রথম সুশি চাল সেদ্ধ করতে পারিনি, তখন মনে হয়েছিল সব শেষ, কিন্তু সেই ভুলই আমাকে শিখিয়েছে নিখুঁত চাল তৈরির কৌশল।
২. ধৈর্য আর অধ্যবসায় যেকোনো কঠিন কাজকে সহজ করে তোলে। জাপানিজ রান্নার মতো জটিল ক্ষেত্রে সফল হতে হলে তাড়াহুড়ো না করে প্রতিটি ধাপে পূর্ণ মনোযোগ দিতে হয়। মনে রাখবেন, রোম একদিনে তৈরি হয়নি, আর আপনার দক্ষতাও রাতারাতি তৈরি হবে না।
৩. নিজের কাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রাখুন। যখন আপনি আপনার কাজকে শিল্প হিসেবে দেখবেন, তখন তা কেবল একটি কর্ম থাকবে না, আপনার আবেগ আর সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ হয়ে উঠবে। এই ভালোবাসা আপনাকে কঠিন সময়েও অনুপ্রাণিত করবে।
৪. অন্যদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া (feedback) গ্রহণ করতে শিখুন এবং সেগুলোকে উন্নতির সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করুন। সমালোচনার মাধ্যমে আমরা নিজেদের দুর্বলতাগুলো চিনতে পারি এবং সেগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারি। আমি সবসময় আমার গ্রাহক এবং সিনিয়র শেফদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছি।
৫. নিয়মিত স্ব-পর্যালোচনা করুন এবং নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যান। শেখার প্রক্রিয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা কখনো শেষ হয় না। প্রতিদিন নতুন কিছু শেখার আগ্রহ আপনাকে একজন সেরা মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে।
গুরুত্বপূর্ণ সারসংক্ষেপ
আমার এই সম্পূর্ণ জাপানিজ রান্নার যাত্রা থেকে কয়েকটি মূল বার্তা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই। প্রথমত, যেকোনো নতুন দক্ষতা অর্জনের পথে চ্যালেঞ্জ আসবেই। আমার সুশি চাল তৈরির প্রথম দিকের ব্যর্থতা থেকে শুরু করে রামেন ব্রথের স্বাদ আয়ত্ত করা পর্যন্ত, প্রতিটি ধাপে আমি অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, এই চ্যালেঞ্জগুলোই আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে দৃঢ় থাকতে হয় এবং প্রতিটি ব্যর্থতাকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখতে হয়। দ্বিতীয়ত, ধৈর্য এবং অধ্যবসায় সাফল্যের অপরিহার্য চাবিকাঠি। কঠিনতম রেসিপি থেকে শুরু করে রান্নার সূক্ষ্মতম কৌশলগুলো আয়ত্ত করতে যে সময় আর নিষ্ঠা প্রয়োজন, তা কেবল ধৈর্য দিয়েই অর্জন করা সম্ভব। মনে রাখবেন, কোনো শর্টকাট নেই, কঠোর পরিশ্রমই আপনাকে আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। তৃতীয়ত, প্রতিটি উপকরণের সাথে পরিচিত হওয়া এবং তাদের সঠিক ব্যবহার জানাটা অত্যন্ত জরুরি। জাপানিজ রান্নায় ঋতুভিত্তিক উপকরণ এবং স্বাদ ও টেক্সচারের ভারসাম্য বজায় রাখা এক ধরনের শিল্প, যা শেখার জন্য গভীর পর্যবেক্ষণ এবং অনুশীলনের প্রয়োজন। চতুর্থত, একজন শেফের যাত্রা কেবল খাবার তৈরি করা নয়, এটি একটি জীবনদর্শন। এটি নিজেকে খুঁজে পাওয়া, নিজের আবেগ প্রকাশ করা এবং মানুষকে আনন্দ দেওয়ার এক অসাধারণ মাধ্যম। আমার এই অভিজ্ঞতা আপনাদের সবার জীবনে একটি নতুন অনুপ্রেরণা নিয়ে আসবে বলে আশা করি।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ) 📖
বন্ধুরা, কেমন আছেন সবাই? আপনাদের প্রিয় বন্ধু আমি, আবার এক নতুন গল্প নিয়ে হাজির হয়েছি, যা হয়তো আপনাদের অনেকেরই খুব চেনা এক অনুভূতির কথা বলবে। আমরা যখন কোনো নতুন স্বপ্ন দেখি, বিশেষ করে এমন কিছু যা আমাদের আবেগের সাথে জড়িয়ে থাকে, তখন শুরুটা যতটা উজ্জ্বল মনে হয়, পথটা কিন্তু সবসময় মসৃণ হয় না, তাই না?
জাপানিজ রান্নার জগতে আমার প্রথম পা রাখাটা তেমনই এক অভিজ্ঞতার সমষ্টি ছিল। আজ অনেকেই হয়তো আমার সুশি বা রামেন তৈরির প্রশংসা করেন, কিন্তু শুরুর দিকের গল্পটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।আসলে, সুশি তৈরি থেকে শুরু করে, এমনকি সাধারণ রান্নার প্রাথমিক কৌশলগুলোতেও আমি বারবার হোঁচট খেয়েছি। মনে আছে, একবার রাইস কুক করার সময় এতটাই ভুল করেছিলাম যে পুরো ব্যাচটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আর তখন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। সেই সময় মনে হতো, এত কঠিন একটা পেশায় টিকে থাকা কি আদৌ সম্ভব?
বিশেষ করে যখন চারপাশে এত বেশি প্রতিযোগিতা আর নিখুঁততার চাপ। অনেকেই হয়তো বাইরে থেকে আমার যাত্রাটা দেখে সহজ মনে করতেন, কিন্তু ভেতরের সংগ্রামটা ছিল অন্যরকম।সেই ব্যর্থতাগুলো আমাকে শুধু হতাশই করেনি, বরং শেখার এক দারুণ সুযোগও করে দিয়েছে। এখন বুঝি, প্রতিটি ভুলই ছিল এক একটি ধাপ, যা আমাকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। আসুন, আমার সেই শুরুর দিনের সংগ্রাম আর সেখান থেকে শেখা দারুণ সব পাঠ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।প্রশ্ন ১: জাপানি রান্না, বিশেষ করে সুশি বা রামেনের মতো জটিল খাবার শেখার শুরুটা কেমন হওয়া উচিত এবং ভুল করলে কী করা উচিত?
উত্তর ১: আহা, এই প্রশ্নটা আমাকে আমার প্রথম দিনের কথা মনে করিয়ে দিল! যখন আমি জাপানি রান্নার জগতে পা রেখেছিলাম, আমারও কিন্তু একই প্রশ্ন ছিল। অনেকেই মনে করেন, সুশি বা রামেন মানেই বুঝি কঠিন কোনো শিল্প, যা কেবল প্রফেশনাল শেফরাই পারেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার মতো একজন সাধারণ মানুষও যদি পারে, তাহলে আপনারাও পারবেন। শুরুটা হওয়া উচিত সহজ কিছু দিয়ে, একদম বেসিক থেকে। আমার পরামর্শ হলো, প্রথমে রাইস কুকিংয়ের খুঁটিনাটি শিখে নিন। জাপানি রান্নার প্রাণ হলো ভাত, আর সেটি সঠিকভাবে তৈরি করতে পারলেই অর্ধেক যুদ্ধ জেতা হয়ে যায়। মনে আছে, আমি রাইস কুকারে একবার এমন ভুল করে ফেলেছিলাম যে ভাতগুলো হয় একদম আঠালো হতো, নয়তো শক্ত পাথরের মতো। তখন মনে হতো, ইসস!
এইটুকু জিনিসও ঠিকঠাক করতে পারছি না! কিন্তু আমি দমে যাইনি। বারবার চেষ্টা করেছি, ভিডিও দেখেছি, পুরোনো জাপানি শেফদের টিপস পড়েছি। ভুলের জন্য একদমই হতাশ হবেন না। ভুলগুলো আসলে আপনার সেরা শিক্ষক। প্রতিটি ভুলের পর ভাবুন, ‘কেন এমন হলো?’ এবং পরের বার সেটা ঠিক করার চেষ্টা করুন। যখনই ভুল করবেন, নিজের উপর রাগ না করে বরং ভাবুন, ‘আহা, দারুণ একটা জিনিস শিখতে পারলাম!’ আমার অভিজ্ঞতা বলে, এই ইতিবাচক মনোভাবই আপনাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।প্রশ্ন ২: রান্নার প্রাথমিক ভুলগুলো কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায় এবং একজন নতুন রাঁধুনির জন্য আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর ২: দারুণ প্রশ্ন! এইটা তো আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটা বিষয়। প্রথমদিকে আমি এত ভুল করতাম যে মাঝে মাঝে মনে হতো, এই রান্না আমার জন্য নয়! একবার তাওয়ায় ডিম ভাজতে গিয়ে ডিমটাই ভেঙে তেল আর ডিমের খোসার ছড়াছড়ি হয়ে গিয়েছিল। আমার প্রথম সুশি রোল এতটাই বেঢপ হয়েছিল যে সেটাকে সুশি না বলে অন্য কিছু বলাই ভালো ছিল!
সেই সময়গুলো আমাকে শিখিয়েছে যে, ধৈর্য আর অনুশীলন ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমার প্রথম পরামর্শ হলো, ছোট ছোট লক্ষ্য স্থির করুন। একবারে সবটা শিখতে যাবেন না। যেমন, প্রথমে শুধু রাইস কুকিংয়ে পারদর্শী হন, তারপর সবজি কাটার কৌশল শিখুন, এরপর সস তৈরি। প্রতিটি ধাপে সময় নিন, তাড়াহুড়ো করবেন না। আরেকটা জিনিস, অন্য রাঁধুনিদের কাজ দেখুন। ইউটিউবে প্রচুর ভিডিও আছে, সেগুলো দেখলে অনেক আইডিয়া পাওয়া যায়। আমি নিজে ঘন্টার পর ঘন্টা বিখ্যাত শেফদের ভিডিও দেখতাম, তাদের হাত ঘুরানো দেখতাম, রান্নার সময় তাদের অভিব্যক্তিগুলোও লক্ষ্য করতাম। আর সবচেয়ে বড় কথা, সমালোচনা থেকে শিখুন। শুরুর দিকে যখন আমার বানানো সুশি নিয়ে একজন বন্ধু হাসাহাসি করেছিল, তখন একটু খারাপ লেগেছিল বটে, কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, ওর হাসিটা আসলে আমাকে আরও ভালো করতে সাহায্য করেছে। ভুলগুলো থেকে শিখুন, কিন্তু সেগুলো আপনাকে দমিয়ে রাখতে দেবেন না। মনে রাখবেন, আজকের দিনের সেরা শেফরাও একসময় আপনার মতোই ভুল করতেন, কিন্তু তারা হাল ছাড়েননি।প্রশ্ন ৩: প্রতিযোগিতামূলক রন্ধনশিল্পে টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী এবং আপনি কীভাবে আপনার মনোবল ধরে রেখেছিলেন?
উত্তর ৩: এটি এমন একটি প্রশ্ন যা কেবল রন্ধনশিল্পে নয়, জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রেই খুব জরুরি, তাই না? যখন চারপাশে এত প্রতিভাবান মানুষ, তখন নিজের জায়গা করে নেওয়াটা সত্যিই কঠিন মনে হতে পারে। আমি যখন শুরু করি, তখন দেখতাম আমার বয়সী অনেকেই দারুণ দারুণ সব খাবার তৈরি করছে, তাদের দক্ষতা দেখে মাঝে মাঝে নিজের উপর বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলতাম। মনে হতো, আমি কি আদৌ তাদের মতো হতে পারব?
কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, এই প্রতিযোগিতার যুগে টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা হলো ‘ভালোবাসা’ আর ‘অদম্য শেখার আগ্রহ’। আপনি যদি আপনার কাজটাকে মন থেকে ভালোবাসেন, তাহলে কোনো বাধাই আপনাকে আটকাতে পারবে না। আমার মনোবল ধরে রাখার প্রধান কারণ ছিল আমার স্বপ্ন। আমি স্বপ্ন দেখতাম একদিন আমার নিজের হাতে বানানো সুশি মানুষ মন ভরে খাবে। যখনই মন খারাপ হতো, আমি নতুন নতুন রেসিপি নিয়ে গবেষণা করতাম, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতাম যারা আমাকে উৎসাহিত করত, বা এমন সব মানুষের গল্প পড়তাম যারা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সফল হয়েছেন। আর নিজেকে সবসময় বলতাম, ‘আরে বাবা, ভুল করাটা তো শেখার অংশ!
এই ভুলগুলোই আমাকে অন্যদের থেকে আলাদা করবে, আমাকে আরও অভিজ্ঞ করে তুলবে।’ এই মানসিকতাটাই আমাকে বারবার ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন, অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করা বন্ধ করুন এবং নিজের সেরাটা দিন। মনে রাখবেন, আপনার নিজস্ব একটা স্টাইল আছে, একটা নিজস্ব গল্প আছে, যেটা অন্য কারও নেই। আর সেটাই আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি।






